শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০

একজন বাবার আর্তনাদ

https://amzn.to/3seVstG

ঢাকা-কুমিল্লা ট্রেনে উঠেই দেখি আমার উল্টো দিকের সিটে এক অসুস্থ্য বৃদ্ধ মাথা নীচু করে বসে আছেন। টিটিকে টিকিট দেখাতে না পেরে ভদ্রলোক চোঁখে মুখে এতটাই অপরাধী ভাব নিয়ে আছেন যেনো এক খুনের মামলার আসামী। টিটির অকথ্য ভাষায় গালাগালি সহ্য  করতে পারছিলাম না। একটু কর্কষ ভাষায় বললামঃ

- "টিটি সাহেব ফাইনসহ কত? আমি দিয়ে দিচ্ছি।"

টিটি বললোঃ "আপনি দেবেন কেনো?

- "তাতে আপনার কি? টাকা নিয়ে রশিদ কেটে দিন।"

রশিদটা বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বললামঃ

- "বাবা, রশিদটা রাখুন। পথে লাগতে পারে।"

কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ বললোঃ "বাবা তুমি আমার মান সন্মান বাঁচালে।"

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর মৃদু হেঁসে বললামঃ

- "আপনি ঢাকায় কোথায় থাকেন?"

বৃদ্ধ বললোঃ "সে এক ইতিহাস। আপনার কি শোনার সময় হবে?"

- "অবশ্যই, বলুন।"

বৃদ্ধ বললোঃ "আমি নওপাড়া বশিরউদ্দিন স্কুলে সায়েন্সের শিক্ষক ছিলাম।"

শিক্ষক শুনেই আমি বললামঃ

- "স্যার, আমাকে তুমি করে বলবেন।"

"স্যার! বাইশ বছর পর স্যার শব্দটি শুনে চোঁখের পানি ধরে রাখতে পারলাম নারে বাবা।"

টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললামঃ

- "স্যার, আপনার গল্পটা বলুন।"

স্যার বলতে শুরু করলেনঃ "তিন বছর বয়সের যমজ দুটো ছেলে আর মেয়েটি জন্মের সময় ওদের মায়ের মৃত্য হলো। সন্তানদের দিকে তাঁকিয়ে বিয়ে করলাম না। নওপাড়ায় মাথা গুঁজার ঠাঁই করি। সন্তানদেরকে

বাবা-মায়ের আদর দিয়ে বড় করলাম। বড় ছেলেটা নওপাড়া থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলো। ছোট ছেলেটা ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পাশ করলো।"

 

আমি বললামঃ "মেয়েটিকে কি পড়ালেন?"

স্যারঃ "নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজনের ধারনা মেয়েকে লেখা পড়া শিখিয়ে লাভ কি? পরের বাড়ী চলে যাবে। বরঞ্চ ছেলেকে সুশিক্ষিত করে তুললে বৃদ্ধ বয়সে একটু মাথা গুঁজার ঠাঁই হবে। আমরা খুব স্বার্থপর জাতি বাবা। মেয়েটি ইন্টারমিডিয়াট করার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে দিলাম। যদিও ছাত্রী হিসাবে ভালো ছিলো।"

আমিঃ "তারপর?"

স্যারঃ "ছেলে দুটোকে বিয়ে করালাম। ছেলে দুটোর অনুরোধে জমিটুকু বিক্রী করে বড় ছেলে পল্টনে আর ছোট ছেলে উত্তরায় ফ্ল্যাট কিনলো।"

আমিঃ "মেয়েকে কিছুই দেন নাই?"

কাঁদতে কাঁদতে স্যার বললেনঃ "সেটাই একটা বিরাট ভুল। ছেলের বৌদের সিদ্ধান্ত প্রতি মাসের হতে ১৫ বড় ছেলের বাসায় আর ১৫-৩০ ছোট ছেলের বাসা সুটক্যাস নিয়ে ছুঁটাছুটি। মেয়ে অবশ্য বহুবার বলেছে আব্বা আপনি আমার কাছে চলে আসেন। কোন মুখ নিয়ে যাবো? কতদিন যাবৎ বুকের বাম দিকটা ব্যাথা করছে।"

আমিঃ "ডাক্তার দেখাননি?"

মৃদু হেঁসে স্যার বললেনঃ "ডাক্তার আবার, ছোট বৌমাকে বললাম আর কয়েকটা দিন থাকি। সে আমার সুটকেসটা বাহিরে ফেলে দিয়ে ইংরাজীতে বললো See you next month বড় ছেলের বাসায় গিয়ে দেখি দরজায় তালা মারা। দারোয়ান বললো ওরা দু সপ্তাহের জন্য রাশিয়া গেছে। তারা জানে নির্ধারিত সময়ানুযায়ী আমার আসার কথা। পকেটে বিষ কেনার পয়সাও নেই। তাই ভাবলাম মেয়েই শেষ অবলম্বন।"

আমিঃ "আপনার মেয়ে কি করে?"

 

স্যারঃ "মেয়ের স্বামীটা খুব ভালো। ওকে চট্টগ্রাম থেকে কম্পিউটার সায়েন্সএ পড়িয়ে ওরা দুজনই প্রাইভেট ব্যাঙ্কে আছে।"

 

আমিঃ "আপনার মেয়ে যদি আপনাকে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে না দেয়। আমার আগের ভুলগুলো শুধরে ক্ষমা চেয়ে নিব। "

স্যারঃ "মেয়ের পায়ে ধরে কান্না করলে আমাকে তাঁড়িয়ে দেবে না।"

আমিঃ "এতো আত্মবিশ্বাস? আপনার মেয়ে কি জানে আপনি আসছেন।"

স্যারঃ "না, আমারতো মোবাইল নেই।"

আমিঃ "নম্বর দিন, কথা বলিয়ে দিচ্ছি।"

স্যারঃ "না না বাবা, মোবাইলে তো মেয়ের পাঁ ধরে মাফ চাইতে পারবো না। পরে যদি নিষেধ করে দেয়।"

- "আমি বলছি আপনার মেয়ে কোনদিন বাবা-মাকে তাঁড়িয়ে দেবে না।"

এক প্রকার জোর করে ফোন ডায়রী দেখে স্পিকার অন করে ডায়াল করলাম

আমিঃ "হ্যালো, আপনি কি রেহানা ?"

অপরপ্রান্তঃ "জ্বী, কে বলছেন?"

আমিঃ "আপনাকে একখানা সুখবর দেওয়ার জন্য ফোন করলাম।"

অপর প্রান্তঃ "কিসের সুখবর?"

আমিঃ "কিছুক্ষনের মধ্যে আপনার বাবা অর্থাৎ স্যার আপনাদের ওখানের রেল স্টেশনে পৌঁছাবেন।"

মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলোঃ "এই শুনছো, আব্বা আসছেন। চলো আমরা স্টেশনে যাই। কতদিন হয় আব্বাকে দেখি না। সাহিল চল বাবা, তোর নানা ভাই আসছে, চল স্টেশনে যাই।"

 

কিছুক্ষন পর স্টেশনে ট্রেনটি ধীর গতিতে চলছিলো। জানালা দিয়ে তাঁকিয়ে দেখলাম। ঘরের সাধারণ কাপড় পড়া স্বামী/সন্তানসহ এক নারী অধীর আগ্রহে তাকিয়ে যাত্রী খুঁজছিলো।

 

তাকানো দেখেই বুঝে গিয়ে স্যারকে বললামঃ "ওইটা আপনার মেয়ে?"

স্যার বেশ নার্ভাস স্বরে বললোঃ "হে বাবা।"

আমি ইশারা দিতেই ওরা দরজার সামনে এসেই স্বামী স্যারের ভাঙ্গা সুটকেসটা নিয়ে পাঁ ছুঁয়ে প্রণাম করলো। মেয়েটি বাবাকে জঁড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। স্যারের চোঁখ ভরা অশ্রু আমাকে বাই দিলো। ট্রেন ছুটতে লাগলো।মেয়ে, জামাই আর নাতি স্যারকে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যাচ্ছে আর ট্রেনটির দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলো।

মেয়েটির কান্না দেখে মনে হলো মা তাঁর হাঁরিয়ে যাওয়া সন্তানকে বহুদিন পর ফিরে পেলো।

 

আকাশের দিকে তাঁকিয়ে ভাবছিলাম, "আজ আমার বাবা বেঁচে থাকলে এই আনন্দ থেকে আমিও বঞ্চিত হতাম না।"

 

- একজন বাবার আর্তনাদ

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার সন্তানের বুদ্ধির বিকাশ কিভাবে ঘটাবেন ??

  https://amzn.to/3KHLreQ একজন অভিভাবক হিসেবে সন্তানের উৎকর্ষতার দিকে আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হয়। আমরা সকলেই আমাদের সন্তানের মেধার বিকাশের ...