বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০

অসমাপ্ত ভালোবাসা

ক্ষুধায় পেট এর ভিতর ইঁদুর দৌড়াছে মনে হয়। প্রচুর খিদে পেয়েছে। সম্পাকে প্রাইভেট পড়াতে ওর বাড়িতে এসেছি। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত্রি আট টা পর্যন্ত ওকে বাড়িতে পড়ায়।সেই অষ্টম শ্রেণী থেকে এই মেয়েটাকে পড়াচ্ছি।
এখন ও ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ে। সম্পার বাবা পুলিশের একজন বড় অফিসার এবং মা হাউস ওয়াইফ। ওদের আর্থিক প্রতিপত্তি তো আছেই সেই সঙ্গে সম্মানও।সম্পা বাড়ির একমাত্র সন্তান।খুব আদরের সঙ্গে বড় হয়েছে।
আর আমি অতিসাধারণ একজন গরীব মানুষ। অভাবের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছি। মাস্টার্স ডিগ্রী তে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি।আমার ইনকামের রাস্তা হলো বিভিন্ন জাইগায় এবং বাড়িতে টিউশনি করা।
 টিউশন থেকে যে টাকা ইনকাম হয় সেই টাকায় আমার নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয় আর গ্রামে আমার বৃদ্ধ পিতা মাতা আছেন উনাদেরকে প্রতিমাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয় যাতে করে উনারা কোনরকম চালিয়ে নেন । গ্রামে মা-বাবা আর একটি ছোট বোন আছে।
আমার বাবা একজন গরীব দিনমজুর। আগে বাবা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন বৃদ্ধ হওয়ায় কোন কাজ ঠিক মতো করতে পারে না। আর আমিও উনাকে কোন কাজ করতে দেই না।
আমার পাঠানো টাকায় তারা কোন রকম চালিয়ে নেন।
 যা বলছিলাম আগে।
 সেই বিকেল ৫ টা থেকে পড়াচ্ছি, এখন সন্ধ্যা হয়ে গেল। ক্ষুধায় কাতর হয়ে যাচ্ছি । দুপুরে সেইরকম কিছু খাওয়া হইনি। অবশ্য আমি প্রায়ই দুপুরে সেই রকম কিছু খাই না। এর ফলে আমার হাতে প্রতিদিন কিছু টাকা বেঁচে যায়, কারন না হলে আমি বাবা - মার কাছে টাকা পাঠাতে অসুবিধে হয়।

এইভাবে বছর চলে যাচ্ছে। খেলে তো শেষ হয়ে যাবে, এটা আমার চিন্তাভাবনা। সম্পাকে ৫ বছর ধরে পড়াচ্ছি। পড়ানোর সময় প্রথম দিন থেকেই দেখতাম, আমাকে কিছু টিফিন দেওয়া হতো।

এতে আমার অনেক লাভ হয়েছে। দুপুরে সেই রকম কিছু না খেলেও এই টিফিন দিয়ে আমি আমার খিদে মিটে যেত। আজ একটু ব্যতিক্রম লাগলো আমার কাছে।
একঘন্টা পড়ানো হয়ে গেছে, এখনও কাজের মেয়েটা টিফিন নিয়ে এলো না তো। এই রকম সাধারণত হইনা ।
 টিফিন হয়তো আসবে না,এই কথা মনে হতেই ক্ষুধাটা আরও বেড়ে গেল। একটু অন্যমনস্ক ছিলাম তাই সম্পা ডাক দিলো, --ভাইয়া। --হা বলো। --আপনি কিছু ভাবছিলেন..? --নাতো। --আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি একটু ভিতরের ঘর থেকে আসছি। সম্পা ভিতরের রুমে কেন গেল কে জানে।এই মেয়েটাকে পড়িয়ে অনেক রিলক্স পেয়েছি। খুব মেধাবী ছাত্রী। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না কোনো কিছু বোঝানোর জন্য। অল্প বোঝালেই সব কিছু বুঝতে পারে। সম্পা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আমি একটু লজ্জিত বোধ করলাম।
সম্পা কিছু বুঝে ফেললো নাকি? সম্পা বলল, --আজকে কাজের মেয়েটা আজকে আসে নি। তাই টিফিন দিতে একটু দেরি হয়ে গেল। --আরে সমস্যা নাই। সব ঠিক আছে। কষ্ট করে আনতে গেলে কেন? সম্পা কিছু বলল না।একটা বাঁকানো হাসি দিল।আমি খাবার হাতে নিলাম।
 পেটে ক্ষুধা নিয়ে ওদিকে তাকানোর সময় কোথায়। আমি খাবারের প্লেটের দিকে লক্ষ্য করলাম। চা, পাঁচটি বিস্কুট, দু’টুকরো কেক দিয়ে প্লেট টি সাজানো। আমার জন্য এই টিফিন টিই বেশি ছিল। খাবার শেষ করে দেখি সম্পা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
 আমি একটু অস্বস্তিবোধ করলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে হয়তো একটু তাড়াতাড়ি ভাবে খাবার গুলো শেষ করে ফেলেছি। সম্পা বলল, --ভাইয়া আজও আপনি নীল শার্টটি পড়ে এসেছেন..? -সবুজ জামাটা ধুয়ে দিইয়েছি। --আপনার আর শার্ট নাই? শুধু নীল আর সবুজ জামা। (সত্যি কথা বলতে আমার আসলে আর বেশি জামা নেই। এই দুটো শার্ট। দুদিন আগে দেখলাম লাল জামাটা ইঁদুর কেটে ফেলেছে।)
 এই কথা অবশ্য সম্পকে বলা যাবে না।
তাই চুপচাপ হয়ে গেলাম। --আমি আপনাকে দুটো জামা উপহার দিতে পারি। --আচ্ছা দিও।এখন যেটা করছো সেই পড়ায় মন দাও।
সম্পকে পড়িয়ে বাসায় ফিরলাম। আজ ১৫ ই আগস্ট। সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে ভালো সময় কাটালাম। বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম। ভালই মজা হলো। সন্ধ্যায় সম্পকে পড়াতে গেলাম ওদের বাড়িতে।
 সম্পার সাথে দেখা হলো না। ওর মায়ের সাথে কথা হলো এবং মায়ের কাছ থেকেই জানতে পারলাম সম্পার আংটি বদল হয়ে গেছে। এক সেনাবাহিনীর স্টাফ এর সাথে। তাই আজ আর পড়তে বসতে চাইনি। আমি ও ছুটি পেয়ে গেলাম।
বাসার দিকে ফিরছি।
আজ আর ক্ষুধা লাগছে না। ইঁদুর আর পেটের মধ্যে ছুটাছুটি করছে না। কেমন যেন আজকে মনটা উদাস হয়ে গেল। কোনো কিছুই সেই রকম ভালো লাগলো না। এই প্রথম সম্পার জন্য মনটা উদাস হয়ে গেল।
আজ বুঝলাম সম্পাকে আমি মনে মনে পছন্দ করতাম। ব্যাথিত মনে বাসায় ফিরলাম। বাসা বলতে ভাড়া বাসা।এক রুমের বাসা।আমি আর সাহিল এক সঙ্গে থাকি।
সে-ও ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। সাহিল বলল,আমার নামে একটা পার্সেল এসেছে। দেখলাম রঙ্গীন কাগজে মোড়ানো একটি বাক্স।
আমাকে আবার কে পাঠালো।অতি আগ্রহ বেড়ে গেল। বক্সটি খুলতেই দুটি শার্ট বেরিয়ে পড়ল।একটি লাল আর একটি সাদা,সাথে একটি চিঠি ও রাখা আছে দেখলাম।

জামা গুলো দেখে আমি বুঝতে পারলাম কে পাঠিয়েছে। আমি চিঠিটি পড়া শুরু করলাম।
 প্রিয় তরুণ, ভাই বলতে পারবো না। অন্য মানুষের সামনে ভাই বলতে হয় কারণ সেটার প্রয়োজন আছে। কিন্তু চিঠিতে কোনো প্রয়োজন নেই। আর আমি কখনোই তোমাকে ভাই হিসেবে মনে করি নি। তুমি করেই বলছি তোমাকে, ঠিক আছে? তরুণ তোমার মনে আছে, একদিন বাবার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল, সেদিন আমি রাগ করে অনেক কেঁদেছিলাম।
তখন আমার বোঝার মত বয়স হইনি। মাত্র এইটে পড়তাম। এই বয়সে অবুঝ হওয়া টাই স্বাভাবিক। তুমি যখন পড়াতে এসেছিলে সেই তখন পর্যন্ত আমি কাঁদছিলাম। তুমি কিছুই বললে না।চুপচাপ করে বসে রইলে।
কিছুক্ষণ পর একটা হাসির ছড়া লিখে দিয়েছিলে।আমি সেদিন হাসির ছড়াটি পড়ে হেসে দিলাম। সেইদিন থেকেই তোমাকে ভালো লাগা শুরু হলো।তুমি খবুই সাধারণ ভাবে চলাফেরা কর। সুন্দর করে কথা বল যা আমাকে ভীষণ ভালো লাগে। আজকে তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম।
 দেখলাম তুমি তোমার কলেজের রেসটুরেন্ট এ একটা মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছো। মেয়েটা কে? তুমি কি মেয়েটাকে পছন্দ করো। আজকে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে ।
তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। অন্য কাউকে বিয়ে করার প্রশ্ন-ই আসে না।তোমাকে জানিয়ে দিলাম। তুমি যদি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাও তাহলেও আমি রাজি আছি।

 ইতি সম্পা।

 চিঠিটা ভাঁজ করে কালো শার্টের পকেটে রেখে বাইরে বের হলাম। ব্যাস্ত রাস্তার পাশ দিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি, এখন আমার কি করা উচিত। আমি গরীব দিনমজুরের অতি সাধারণ একজন ছেলে আর সম্পা সেনাবাহিনীর অফিসারের মেয়ে।
 এদিকে আমি এখনো কোনো চাকরি করি না। চাইলেই সম্পাকে নিয়ে পালিয়ে যাতে পারি কিন্তু যেখানেই যাব সম্পার বাবা সেখান থেকে খুজে বের করে আনবে। তখন দু'জনের ভবিষ্যৎ কি হবে। মোবাইলের রিংটোন টা বেজে উঠলো এবং ভাবনার ছেদ পড়লো।
 --হ্যালো। --হ্যালো।আমি ডিসিপি সঞ্জয়।
সম্পার বাবা।তুমি কি তরুণ???
 --হা আংকেল।
 --তুমি জানো তো সম্পার আজকে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।
 --হা জানি।
 --আজ সম্পা বদমাসি শুরু করেছে।
ও নাকি ওই ছেলে টাকে বিয়ে করবে না। ও নাকি তোমাকে ভালোবাসে। তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি চুপ করে রইলাম।
 --তরুণ ??
 হ্যা আংকেল।

-তুমি এখন কি করবে ভাবছো ?
 --আপনি বলুন।আপনি যা বলবেন, তাই করবো।
 --ঠিক তো?
 --হা ।
 --তোমার রুমে তোমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছি।কাল সকালে এই শহর ছেড়ে যাবে।
 --ঠিক আছে।
 --তোমাকে যেন এই শহরে আর না দেখি।
 -ঠিক আছে ।
 এরপর রুমে এসে কিছু খেয়ে মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের দেশে চলে গেছি নিজেই জানি না।
 সকালে গ্রামে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।তখন প্যান্টের পকেটে রাখা লেনোভো মডেলের মোবাইলটা বেজে উঠলো।
মোবাইলটা বের করে দেখলাম কেউ একজন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছে।
 ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে,
 --হ্যালো। তরুণ?
--হা । কে বলছেন?? --আমি বলছি.......

 #

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার সন্তানের বুদ্ধির বিকাশ কিভাবে ঘটাবেন ??

  https://amzn.to/3KHLreQ একজন অভিভাবক হিসেবে সন্তানের উৎকর্ষতার দিকে আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হয়। আমরা সকলেই আমাদের সন্তানের মেধার বিকাশের ...